কবিতা এক নিবিড় করমর্দন
চিন্তা করে কখনই কবিতা লিখি না আমি। গভীর চিন্তা থেকে নয়, কোনো গোপন ছক কষে নয়, কী হাসিল হবে বলা মুশকিল সীমারেখাটাই যেখানে অত্যন্ত অস্পষ্ট। একটা বিশেষ কালে সেই সময়টার তাগিদে জন্মকাল নির্বিশেষে সবাই কবিতা লেখে তাতেও এক একজন কবি বেছে নিতে পারেন তার কবিতার উপকরণ। আমি মনে করি এই বেছে নেওয়ার পেছনেও কবির ব্যক্তিগত জীবন ও অভিজ্ঞতার প্রবল একটা ছাপ থাকে। আসলে ভালোর ভেতর থেকে খারাপকে, খারাপের ভেতর থেকে ভালোকে টেনে, ছিঁড়ে, খুলে পুরো ভাবনাটাকে তছনছ না করলে এই ভালো-মন্দের আসল চেহারাই খোলে না!
কবিতা হচ্ছে কথার শিল্প। আর একে তৈরি করার একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে শব্দ। অতীত বা পুরান নিঃসৃত হয়েই বারবার জন্ম নেয় নতুন একটি কবিতা। এখন এর মধ্যে থাকতে পারে আমার স্পর্শকাতর জীবন, থাকতে পারে সামাজিক ধ্যান-ধারণা, রাজনৈতিক দোলাচল। এছাড়া বিজ্ঞান, দর্শন, অতীত, ভবিষ্যৎ এসবের ফিজিক্যাল অ্যাপ্রোচ দিয়ে গড়ে ওঠে কবিতা। ‘প্রেমহীন’ কথাটা কোথাও কখনই জুতসই নয়। এখন দেখার বিষয় কিসে প্রেম, কার প্রেম, কে কাকে দিচ্ছে, কে নিচ্ছে, কতটা বহন করতে পারছে? বায়োলজিক্যাল ব্যাপারটার মধ্যে প্রেম কতটা থাকে বা থাকলেও ওই অর্থে থাকে হয়তো! থাকতে পারে। উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু ধরা যাক বালি-কাদায় চুম্বকের মতো আটকে থাকা ছোট্ট নৌকাটা, যাত্রী ওঠার পর মাঝি শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাকে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। এরপর সে মাঝ নদী পেরিয়ে ওপারে যায়। কিন্তু আমি বলছি ওই যে ওই ব্যাপারটা, গলুইটা বালি-মাটি-কাদা থেকে ছিন্ন হলো, খস একটা আওয়াজ আর নিউটনের সূত্রকে মেনে যাত্রীরা পেছনের দিকে খানিকটা হেলে পড়ল, তাই তো। জাস্ট ওইটুকু। কী জানি ভীষণ রোমান্টিক। নয় কি? বর্ষায় পাট পচার সেই গন্ধটুকু, শীতের বার্তা দিতে আজও আমি ছাতিম ফুলের বিটকেলে গন্ধকে প্রেম জ্ঞানে প্রণাম করি। চৈত্রে যে পাতাটা বোঁটা থেকে ছিন্ন হয়ে উদাস হাওয়ায় অলস গতিতে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ল। এরপর তা ছাগলে খেল নাকি জ্বালানির জন্য উনুনে গেল ততদূর নয়। আমি বলছি ওই গাছ থেকে পড়াটুকু, সামান্য মুহূর্তটুকু। ওটাই প্রেম। আমার আনন্দ। আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। এ রকম হাজারো অনুষঙ্গ প্রেমের প্রলেপ দিয়ে আমার কবিতায় সংকটের সহায় হয়ে দাঁড়ায়।
শিবলী মোকতাদির
শিউলি ও শেফালি
কোনো লুকোচুরি নেই,
স্থানে অস্থানে পড়ে আছে পঙ্ক্তিনির্ভর সজ্জিত শরৎ।
দূরে স্থাপত্য যুদ্ধের উসকানি, বাতাসে গুলির শব্দ
শিশির ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে সিসা।
স্থির থাকো, কাউকে দিয়ো না গুপ্তহত্যার নথি।
এখনও জাগেনি গোলাপ,
সংগীত ভেঙে সুরের সহস্র ধারায়
ধীরে ধীরে আমার প্রচ্ছদে নেমে আসো।
প্রযত্নে যা-কিছু পাঠাই - চাঁদ জানে।
প্রলয়সন্ধ্যা আলোকিত করে ফিরেছে কোরক
রাশি রাশি পরিযায়ী পাখির স্বরূপে।
আশ্বিন- এ কেমন আশ্চর্য ঠিকানা তোমার!
দুঃস্বপ্নেও যদি বৃষ্টি নামে,
বনপুলকের গন্ধে কোথায় লুকাবে মুখ বিভ্রান্ত বালক!
দপ্তরবিহীন আলাভোলা এই ঋতু
তবু দোষ দেবে- শিউলি কেন শেফালি হয়ে ঝরে?
প্রেমের সংজ্ঞা
বারোয়ারি পরীক্ষা ছেড়ে বিকীর্ণ ব্যর্থ পুরুষ
মাটিতে গর্ত কেটে, টিরকূটে ‘প্রেম’ লিখে
বসে আছে পাশে।
জীবনবিরোধী চক্রান্ত কি না শুধাতেই বলল :
না দাদা, দেখছি মানুষ কী করে প্রেমে পড়ে?
বাতাসে বসন্ত বহমান।
চিরচেনা বিজ্ঞান অসংশয়ে দুই চোখ মেলে
কানে কানে বলে-
দিনে নব্বই ডেসিবেলে কলহ, রাতে বিশ ডেসিবেলে প্রেমালাপ
মূলত এই তরঙ্গেই মানুষ প্রেমে পড়ে।
কেননা, তরঙ্গের মতো ভালোবাসার ওঠানামা না ঘটলে
প্রেমে সাম্রাজ্যবাদ জেঁকে বসে।
তাহিরপুর
মুক্ত হলো বন্দিদশা
উড়ে গেল পায়রাগুলো
আধেক ফেটে যেমন ঝরে
শিমুল তোমার শীর্ণ তুলো।
নাতিদীর্ঘ হৃদয় গলে
ঘ্রাণ পাঠালে ব্যস্ত বনে
আমার হাতে তোমার ব্যথা
পাশ ফিরেছি অবন্ধনে।
বসন্তে হয় ক্লান্তিবোধ
রক্তকমল ফুটছে ভয়ে
স্মৃতির কাছে যুক্তি এসে
বুক পেতে দেয় বাক্সময়ে।
পূর্ণিমা আজ গভীরতম
প্রেম করিবার বাঞ্ছা দিয়ো
চোখের মণি পাথর করে
দিতেই পারি অঙ্গুরীয়।
যুক্তি ভুলে যুদ্ধ করো
শিল্প বানাও পোড়ামাটি
সায়াহ্নে এই চোখের কাছে
দৃষ্টি তোমার অধিক খাঁটি।
বৃত্ত ভেঙে রেখায় চলো
টিপ হারালে কী আর ভয়
তুলির টানে তাহিরপুরে
শিমুল ভরা চন্দ্রোদয়।
স্বাতন্ত্র্য
মাধুরীকে সংজ্ঞায়িত করি বেদনার কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে।
মহুয়ার ডালে ময়ূর বসে না কখনও
মৌরীর ঘ্রাণকে নস্যাৎ করে,
পদে-পদে বোটকা গন্ধের ছাপ রেখে
হেলেদুলে চলে গেছে বাঘ।
ডুমুরের সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত হরিণ
পারদে পূর্ণ হয়ে দিশেহারা দাঁড়কাক
বৃষ্টি পড়ছে বনে, পুরো অরণ্য ভিজে ফানাফানা
পেখম মেলেছে ময়ূর, শিকারে মেতেছে বাঘ
গোলাপের গন্ধে আচমকা নেমেছে নির্জন
তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে কামনাকথন।
আরও পড়ুন:
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
মহিমাগঞ্জ
আসো আসো ট্রেন অপেক্ষা করি
কতদূর বেঁকে সোজা হবে তুমি
ভোরের মালতি খোঁপা হতে ঝরে
রোদে ছায়া নেই হাওয়া মৌসুমি।
চক্রবৃদ্ধি হারে এখানে শরৎ বাড়ে
আকাশে থাকে মেঘ, প্রজাপতি
পালিয়ে যাচ্ছি চুরি করে তাকে
সঙ্গে নেবার দিলে না তো সঙ্গতি!
রাশি রাশি লোক কোথায় যে যায়?
বৃষ্টি ঠেলে কেউ বা পড়ে ঝড়ে
ছাতা আর মাথা ভিজে একাকার
পুরনো পুরুষ কেঁদে মরে অন্তরে।
কায়া ঘন হয় সন্ধ্যা নেমে আসে
খাঁ খাঁ করছে শূন্য টিকিট ঘর
সচেতনভাবে সোনার বালাটা দেখি
রুপোর আলো ঝলসাল তারপর।
এলে তুমি ট্রেন লোহার কারবারি
এখানে-সেখানে ফুটো-ফাটা স্পঞ্জ
ফুলের মধ্যে পদ্ম আমার প্রিয়
তাকে দেখতেই যাচ্ছি মহিমাগঞ্জ।