জাতীয় ঐক্য, ত্যাগ ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, যখন জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, তখন প্রশ্ন ছিল না- কে কোন রাজনৈতিক আদর্শের, কোন দলের কিংবা কোন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অভূতপূর্ব সম্মিলন হয়েছিল, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পুরো জাতি এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। সেই গণ-অভ্যুত্থানে মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল একটি স্বপ্ন নিয়ে- স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে নিরাপদভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
এই আন্দোলনে ছিল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসাছাত্র, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী; সঙ্গে ছিলেন তাদের অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইনজীবী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক এবং প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষরাও। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তি ছিল একটি পরিচয়, তা হচ্ছে- আমরা সবাই গণতন্ত্রকামী মানুষ। মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার প্রবল সাহস আর উদ্দীপনাই পৌঁছে দিয়েছিল বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে।
এই গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে মূল কারণ ছিল মানুষের দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, ২০১৪ সালের ‘বিনাভোটের’ নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘নিশিরাতের’ নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের ‘ডামি ভোটের’ নির্বাচন। এই প্রতিটি প্রহসনই জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা লুণ্ঠন করেছে। সুতরাং, গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাক্সক্ষা ছিল একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যেটি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে, যাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে, অর্থাৎ গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এক বছর পর আজ বাস্তবতা হলো- ফ্যাসিবাদবিরোধী সেই জাতীয় ঐক্যে চিড় ধরেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এমনকি নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা অনেক দলও এখন যেন নিজেদের আদর্শ ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- এই আন্দোলনে ২০০০-এর মতো মানুষ জীবন দিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী ছিল। তারা প্রত্যাশা করেছিল একটি ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। এমন একটি বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই, যেখানে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ হবে আমাদের মূলমন্ত্র।
বিএনপি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিরামহীনভাবে লড়াই সংগ্রাম করেছে। সেই আকাক্সক্ষা থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০২৩ সালে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রণয়ন করেছিলেন ঐতিহাসিক ৩১ দফা, যা ছিল একটি বৃহত্তর জাতীয় সংস্কারের রূপরেখা। গত বছরের ১৬ জুলাই তিনি ১ দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেন, যা এখনও তার ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টে রয়েছে। সেই ঘোষণায়ও তিনি বারবার জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে বিএনপির ৪২২ জন মানুষ জীবন দিয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা একদম শুরু থেকে ছাত্রদের অধিকায় আদায়ের লক্ষ্যে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের প্রতিটি পদক্ষেপেই তিনি স্পষ্ট বার্তা রেখে গেছেন।
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে বিএনপি এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা ভুলে সকল মানুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দেওয়া হবে। যাতে শহীদদের ত্যাগ ও গণতন্ত্রকামী মানুষের সংগ্রাম বৃথা না যায়। আমরা হয়ত শহীদদের জীবন ফিরিয়ে আনতে পারব না, অশ্রুসিক্ত মা কিংবা বেদনার্ত স্ত্রীকে হারানো প্রিয়জন ফিরিয়ে দিতে পারব না; কিন্তু যারা ষোলো বছর ধরে গুম, খুন, হামলা, মামলা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যেও গণতন্ত্রের পক্ষে রুখে দাঁড়িয়েছেন- তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাই মিলে মানবাধিকার, আইনের অনুশাসন এবং বাকস্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সফলতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ রাষ্ট্রের মালিক, সেটি আমাদের সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। গত বছরের ৮ আগস্ট যে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ভিত্তি ছিল সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি ও জাতীয় ঐকমত্য। এই সরকার গঠিত হয়েছে স্টেকহোল্ডারদের সহায়তা ও সমর্থনের ভিত্তিতে, যার প্রধান দায়িত্ব যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করবে, রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসের প্রতিদান দেবে এবং জনগণের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে- এটাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা, এটাই আজ গণমানুষের প্রত্যাশা।
বর্তমানে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে একটি সর্বজনীন প্রত্যাশা এমন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা, যেখানে সফল হওয়ার জন্য, নিরাপত্তার জন্য, পারিবারিক সমৃদ্ধির জন্য কাউকে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল করতে না হয়। যেখানে যার যার যোগ্যতার ভিত্তিতে, মেধার ভিত্তিতে প্রত্যেকে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় মূল্যায়িত হবে।
আরও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের পথচলা
আর সেই লক্ষ্যেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে কী ধরনের জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করা যায়, কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়- তা নিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাই তারেক রহমানের প্রণীত ২০২২ সালের ২৭ দফা এবং ২০২৩ সালে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক সকল রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে গৃহীত ৩১ দফায় বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরের সুনির্দিষ্ট রূপকল্প উপস্থাপিত হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পায়ন, কৃষি, নগরায়ণ, জ্বালানি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পরিবেশ- এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেটি নিয়ে তারেক রহমান সুবিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। এই প্রত্যেকটি সেক্টর ধরে তার যে সুনির্দিষ্ট পলিসি প্রোগ্রাম রয়েছে, তা তিনি এক বছর ধরে জাতির সামনে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি জনগণের রায়ে নির্বাচিত বিএনপি সরকার জনসমর্থন নিয়ে, জনসম্পৃক্ততা বজায় রেখে, সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, ইনশা আল্লাহ।
আগামীর যে বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক যে পথযাত্রা; সেটি অর্থবহ হবে তখনই, যখন দেশের প্রতিটি মানুষের সমস্যা সমাধানে এবং ভাগ্যের পরিবর্তনে রাষ্ট্রের যিনি প্রধান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়োজিত থাকবেন। সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা ঐক্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। গণ-অভ্যুত্থনে প্রতিটি মানুষের ত্যাগ, প্রতিটি শহীদের রক্ত আমরা অর্থবহ করে তুলব এবং একটি আদর্শিক সহাবস্থানের বাংলাদেশ গড়ে তুলব, ইনশা আল্লাহ।