শাহবাগ থানা থেকে দুই শিক্ষার্থী ছাড়িয়ে আনা : ব্যক্তিগত এক বয়ান
কোনো কোনো ঘটনা অনেক সময় রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়, মানুষের মাঝে সাহস সঞ্চারে সহায়তা করে, মনের ভীতি দূর করে রাস্তার মিছিলে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। সে রকমই একটি ঘটনা ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও ইংরেজি বিভাগের মেহেদী আর শরীফুলকে শাহবাগ থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা। কীভাবে তাদের বের করে আনা হয়েছিল বা বের করে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা জনপরিসরে কখনোই আসেনি। গণমাধ্যমে দেখা বের করে আনার স্থির বা সবাক চিত্র দেখে একেক মানুষ একেকভাবে এটাকে বুঝেছেন। তবে এই দুই শিক্ষার্থীকে শাহবাগ থানা থেকে বের আনার পরিকল্পনার সঙ্গে মূলত আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কভুক্ত (বিশিনেট) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী থানায় আটক আছে বলে জানতে পেরেছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কথা আমাদের অজানা ছিল। আসলে কী ঘটেছিল, কীভাবে তাদের ছাড়িয়ে আনলাম, তারই বর্ণনা আমার নিচের ব্যক্তিগত এই বয়ানে।
১৫ জুলাই ২০২৪ : ক্ষোভ আর বিক্ষুব্ধ মন
বিকাল ৩টা-সাড়ে ৩টা, যদি ভুল না করি। আমি বিভাগ থেকে বাসার দিকে ফিরছি। চারদিকে মিছিল, পাল্টা মিছিল, বিজয় একাত্তরে সংঘর্ষ- এসব কিছু হয়ে আমার আবাসস্থল শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পাড়ার গেটের সামনে পৌঁছাতেই দেখি একটি মিছিলের ওপর আক্রমণ। একটা রঙচটা বাসে করে বাইরে থেকে আনা মস্তান, কিশোর গ্যাং টাইপের অল্প বয়স্ক বেশ কিছু ছেলে মিছিলের শিক্ষার্থীদের লাঠিসোটা, উইকেট দিয়ে বেদম পেটানো শুরু করেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। বাসটি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা সাদ্দামের হল হিসেবে পরিচিত স্যার এএফ রহমান হলের মূল গেটের সামনে দাঁড় করানো ছিল। ও রকম মুহূর্তে আমি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে যাব, এ রকমটা ভেবে সামনে এগোতে গেলে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপন্থি চারুকলার একজন শিক্ষক পেছন থেকে আমাকে টেনে ধরে পাড়ার ভেতরে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের না, বিপদে পড়বেন!
বাসায় এসে নিজের মন খারাপ আর ভয়ানকভাবে বিক্ষুব্ধ। মেজাজ ভালো করার জন্য শিক্ষক নেটওয়ার্কের রুশাদ আর নিত্রার সঙ্গে কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য দ্রুতই আমাদের কিছু করা উচিত বলে আমরা একমত হই।
১৬ জুলাই, ২০২৪ : থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার গোপন পরিকল্পনা
আবু সাঈদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জনকে হত্যার খবর আসলে আমাদের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকাটা অসহ্য লাগছিল। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ফোনে জানাচ্ছিল, চাঁনখারপুলসহ পুরান ঢাকার অনেক জায়গায় হাজী সেলিমের লোকজন মিছিলের ওপর সরাসরি গুলি করছে এবং অনেকেই আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে। কেউ কেউ জানাল তারা চিকিৎসা পাচ্ছে না ঠিকমতো! তাই ১৬ জুলাই বিকালেই নিত্রা, তাসনিম আপা, রুশাদ, মান্নান, জগন্নাথের সোম্য সরকার ক্যাম্পাসে জড়ো হই আর আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকা মেডিক্যালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। সেখানে গিয়ে পরিচালকের সঙ্গে জরুরি বিভাগে দেখা হলে ঠিকমতো চিকিৎস দেওয়ার অনুরোধ করি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা পাই জগন্নাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে। কিছুক্ষণ পরপর একের পর এক আহত শিক্ষার্থীদের রিকশা আর ভ্যানে করে নিয়ে আসা হচ্ছিল। অনেক রিকশাচালক, ভ্যানচালক ভাইয়েরা টাকা না নিয়েই ফেরত যাচ্ছিলেন। পুরোই যেন ফিলিস্তিনের গাজার কোনো হাসপাতাল হয়ে উঠেছিল যেন ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগ! চিকিৎসকরা আহতদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল। খোঁজখবর করে বাসায় ফিরি। সেই রাতেই নেটওয়ার্কের জুম সভায় সবাই একমত হয় যে, শিক্ষার্থীদের পাশে আমরা বরাবরের মতোই দাঁড়াব, যতই বিপদ আসুক না কেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন সকালে (১৭ জুলাই) সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্যোগেই অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ হবে।
মিটিং শেষ করে খেতে বসতে বসতেই একটা ফোনকল বেজে ওঠে। পরিচয়ে জানতে পারলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক শিক্ষার্থীর বড় ভাই। তিনি জানালেন, তার ছোট ভাইকে শাহবাগ থানায় আটকে রাখা হয়েছে, কোনোভাবেই ছাড়া হচ্ছে না বা দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন! শিক্ষক নেটওয়ার্ক কোনো সহযোগিতা করতে পারে কি না? আমি বললাম, দেখি কী করা যায়।
আরও পড়ুন:
শাহবাগে মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে বাসে আগুন
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি দর্শন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে ফোন দিলাম এবং সবকিছু শুনে উনি কেমন যেন গাইগুই করতে থাকলেন। বুঝতে পারলাম, উনি কোনো ধরনের কিছু করবেন না। পরে ওই বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উপদেষ্টা, আমার পূর্ব পরিচিত সাঈদকে ফোন দিলে ও উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জানায় আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু করার উপায় নেই। তবে শিক্ষক নেটওয়ার্ক কোনো পদক্ষেপ নিলে তাতে থাকবে আমাদের সঙ্গে। এর পরই আমি অধ্যাপক নিত্রাকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে সবকিছু জানাই। কথার এক ফাঁকে আমি প্রস্তাব দেই, মৌন মিছিল নিয়ে সরাসরি শাহবাগ থানায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসলে কেমন হয়। নিত্রা এতে পুরোমাত্রায় সায় দেয়। তবে সে সতর্ক করে, এটা যেন আগেভাগে কাউকে না জানাই। আগে জানালে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কেউ জেনে গেলে কাজটা আর শেষ পর্যন্ত করা যাবে না।
১৭ জুলাই ২০২৪ : ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ ও থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা
দিনটি ছিল আশুরার ছুটি এবং সব দোকান বন্ধ। আমি দুশ্চিন্তায় আছি ব্যানার বানানো নিয়ে। নিত্রা চারুকলার দুজন শিক্ষার্থীকে দায়িত্ব দিয়েছিল ব্যানারটি নিয়ে আসার। সাড়ে সাতটা-আটটা বেজে গেলেও তাদের কোনো দেখা নেই। কাজটি আবার করিয়ে নেওয়ার মূল দায়িত্ব ছিল ক্রিমিনোলজি বিভাগের আদনানের। এদিকে মাইক্রোফোনে রিকশা ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ আর প্রক্টর! ইতোমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সোম্য সরকার ক্যামেরা হাতে শহীদ গিয়াসউদ্দিন পাড়ায় আমার বাসায় এসে উপস্থিত। আমার সহকর্মী মান্নানও চলে এলো। এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ব্যানার লেখা হয়নি। আদনানকে ফোন দিলে ও জানায়, কিছুই পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত সেই দুই শিক্ষার্থী শাড়ির পাড়ের মতো লম্বা একটা কালো কাপড় নিয়ে আসে, যা ব্যানার উপযোগী ছিল না। বিপত্তি বাধে, রঙ-ব্রাশ কিছুই নেই! আমার মেয়ের অনুমতি নিয়ে ওর রঙ-ব্রাশ দিয়ে কোনো রকমে সবাই মিলে লেখাটি শেষ করা হয়। ইতোমধ্যে আমাদের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষক আতাউর আমার বাসায় এসে ব্যানার লেখার কাজে হাত লাগায়। শুকাতে গিয়ে আরেক ঝামেলা। ছোট টেবিল ফ্যান, ওয়াল ফ্যান দিয়ে বাতাস করে ব্যানারটি শুকানো হয় কোনো রকম। সবাই মিলে ব্যানারের চার কোণা আর মাঝখানের অংশ ধরাধরি করে সশস্ত্র পুলিশের সামনে দিয়ে সিনা টানটান করে সমাবেশে উপস্থিত হই। ইতোমধ্যে ব্যানার ছাড়াই সমাবেশ শুরু হয়ে যায়! অনেক কসরত করে লুকিয়ে-ছাপিয়ে আরেকজন একটা হ্যান্ডমাইকও নিয়ে উপস্থিত হয়ে যায় সমাবেশে।
নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে বিশিনেট ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরাও ছিলেন। এদের অনেকেই গা বাঁচিয়ে চলতেন সবসময়, আবার নিজের রাজনৈতিক পরিচয়কে আড়াল করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে সময়ে সময়ে সুবিধা নিয়েছেন, সেই সময়কার কোনো কোনো সর্বাধিক বিতর্কিত ডিন বা উপ-উপাচার্যের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন।
অপরাজেয় বাংলা থেকে আমরা মিছিল নিয়ে সোজা শাহবাগ থানায় চলে যাই। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত, সাঁজোয়া যান নিয়ে উপস্থিত বিভিন্ন বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে আমরা জোর করে ভেতরে ঢুকে জানতে পারি থানায় একজন নয়, আসলে দুজন শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়েছে। অনেক তর্ক-বিতর্ক, বাকবিতণ্ডার পর তাদের ছাড়িয়ে থানার বাইরে নিয়ে আসি। তাদের বাইরে বের করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীর পরিচয় জানতে পারি। পরে সবাই টাকা জোগাড় করে শিক্ষার্থীকে দেই, যেন সে নিজ বাড়িতে ফেরত যেতে পারে। এভাবেই তাদেরকে আমরা উদ্ধার করতে সমর্থ হই। এরপর তাদের দুজনকে নিয়ে অপরাজেয় বাংলায় এসে আবার সমাবেশ করি। আর এভাবেই এই ঘটনাটি খুনি স্বৈরাচারীর ভীতিকর সময়কে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে, যা শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের গণ-অভ্যুত্থানে পর্যবসিত হয়। এই ব্যক্তিগত বয়ানের মধ্য দিয়েই দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনার আসল চিত্রটা অন্তত সামনে আলসো। গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত স্থিরচিত্র বা সচল চিত্র যে সবসময় সঠিক বার্তা জনপরিসরে পৌঁছাতে পারে, ব্যাপারটা তা নয়। সে জন্যই সঠিক বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ আসল ঘটনা সংরক্ষণে। া