জুলাই অভ্যুত্থানের পর নারীদের খোঁজা বন্ধ করুন

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু
০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জুলাই অভ্যুত্থানের পর নারীদের খোঁজা বন্ধ করুন

১৪ জুলাই ২০২৪, রাতে যখন নারীরা হলের তালা খুলে বের হয়ে স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে ফেলল তখনই বুঝেছি, এখন আর তাদের থামানো যাবে না। দেশ একটা বড় পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কারণ নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক এবং অভাবনীয়ভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। পরে দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলায়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ল। স্কুল কলেজের মেয়েরাও সংগঠিত হওয়া শুরু করল। অনেকেই একা এসেছে, অনেক ক্ষেত্রে ছেলে সঙ্গীদের সঙ্গেও এসেছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সেই নারীরা বিভিন্ন জায়গায় যার যার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে অথবা অন্তত তাদের জীবনের পরিবর্তন আসবে- এমন আকাক্সক্ষা ছিল মানুষের মাঝে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সেই আকাক্সক্ষাটা পূরণ হয়নি। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো, একটা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, যা নারীর অংশগ্রহণকে সীমিত করে সবসময়ই। এই আর্থ-সামাজিক অবস্থানে সে লড়াইটা করতে পারে, কিন্তু লড়াইয়ের ফল পায় না। দ্বিতীয় হলো, নারী-বিদ্বেষী মনোভাব। বিশেষ করে যেসব নারী সরব, তাদেরকে অনলাইনে নানাভাবে হয়রানি করা হয়, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে স্লাট শেমিং, মিথ্যা অপবাদ, নানা সমস্যা তৈরি করে, যা অনেক নারীর পক্ষেই অতিক্রম করে সামনে আসা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া নারীদের ওপর যৌন হয়রানির বিচার না হলে একটা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতা তাদের গ্রাস করে। যৌন হয়রানি নিয়ে বিচার চাইলে তাদেরকে বিতর্কিত করে ফেলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে অভিযোগ করছে, তাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জুলাই শহীদের সন্তান লামিয়াকে দেখেছি ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে। এসব ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের অনুৎসাহিত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠী ভিক্টিম ব্লেমিংকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তাদের নিজ উদ্দেশ্য সফল করতে, ক্ষমতার দখল নিতে।

নারীরা বিভিন্ন সামাজিক পরিসরে কোণঠাসা বোধ করে। বিশেষ করে অনেক রাজনৈতিক পরিসরে বা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের অধীনে পদের জন্য যাদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় এবং প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাদের কাজের জন্য যে সময় ব্যয় করতে হয়, তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় নারীবিদ্বেষ মোকাবিলা করতে। অনেক সময় ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাদের সঙ্গে এক ধরনের বাকবিতণ্ডা ও বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীরা টিকে থাকতে পারে না। ফলে অনেক দূর গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে। আবার যারা লড়াই চালিয়ে যায়, তাদেরকে অনেক হয়রানি উপেক্ষা করতে গিয়ে যে পরিমাণ শক্তি অপচয় করতে হয়, তাতে তারা নিজেদের কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা তাদের পূর্ণ ক্ষমতা, বুদ্ধি, মেধা নিয়ে সময়মতো বিকশিত হতে পারে না। ফলে প্রতিযোগিতার নামে অসম প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। প্রান্তিক নারীদের জন্য প্রতিযোগিতা তো আরও অসম।

সামাজিকভাবে নারীদের ছোট করে দেখানো হয়, তাদের চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়, তারা স্বাভাবিকভাবেই বিকর্ষণ বোধ করবে। বিশেষ করে যে নারীরা শহরের বাইরে থেকে আসে, তাদের মধ্যে সহজেই রাজনীতির প্রতি অনীহা তৈরি হয়। নানা ধরনের বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে অস্বস্তি বোধ করে। বেশির ভাগের পক্ষে এই লড়াইটা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ বাধ্য হয় পুরুষ সঙ্গীদের ওপর নির্ভর করতে এবং পুরুষ সঙ্গীরা যদি তাদের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে না এগোয়, তখন দেখা যায় নারীরা স্থান করে নিতে পারছে না। প্রায়ই শোনা যায়, নারীদের জায়গা তাদেরই করে নিতে হবে, কেউ তাদের এগিয়ে দেবে না। বিষয়টা এগিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়, বিষয়টা তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির। যে কোনো টক্সিক পরিবেশে বা নারীবিদ্বেষী পরিবেশে নারীরা অংশগ্রহণ করতে চাইবে না- এটা জেনেই বিশেষ গোষ্ঠী তাদেরকে দূরে রাখার জন্য নানাভাবে তৎপর হয়। আপনি একটা নারীবিদ্বেষহীন পরিবেশ তৈরি করুন, নদীর পানির মতো তারা ধেয়ে আসবে। কিছু নারী, যারা আর্থ-সামাজিকভাবে সচ্ছল ও প্রগতিশীল, তারা এ লড়াইটা শেষ পর্যন্ত করতে পারে। তাদের সঙ্গে প্রান্তিক নারীদের গুলিয়ে ফেলা যাবে না। শ্রেণিভেদে নারীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রবণতা কম বা বেশি থাকতে পারে, সক্ষমতা কম থাকতে পারে। তাই সবসময় তাদের নিজেদের জায়গা করে নিতে হবে- এই যুক্তি সব জায়গায় খাটে না।

আমরা যদি রাজনৈতিক পরিসরে দেখি- উপদেষ্টা হয়েছেন বা বড় বড় পদে যাদের দেওয়া হয়েছে, সেখানেও কিন্তু নারীদের সংখ্যা কম। আমরা এখনও জানি না, কী ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে তাদের নির্বাচিত করা হয়েছে। এটা কি এনজিও সংশ্লিষ্টতা? পূর্বপরিচয়? নাকি আগের রেজিমে ভিক্টিম হওয়া এখানে ক্রাইটেরিয়া? অথবা প্রশ্ন করা যায়, যে নারীরা আছেন, তারা নিজেরা কতটুকু কোণঠাসা হয়ে আছেন? তারা কি তাদের জায়গা থেকে লড়াই করে নারীদের জন্য স্থান তৈরি করতে পারছেন? অর্থাৎ শুধু রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা দিলেই হবে না, তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা থাকতে হবে। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে নারী স্বার্থবিরোধী কাজের অংশ হতে বাধ্য করাও এক ধরনের নারীবিদ্বেষ। সমাজের প্রতিটি স্তরে বিরাজমান এই নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই-ই পারে নারীর অনগ্রসরতা থেকে সমাজকে মুক্ত করতে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর অপূর্ণ আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু ঘটনা, যা নারীর প্রতি সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ এবং সর্বোপরি বৈষম্যকে আরও প্রকটভাবে হাজির করেছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে কিছু ঘটনা আমাদের আহত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারী শিক্ষার্থীকে একজন স্টাফ যৌন হয়রানির পর তাকে যথাপ্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে সেই অপরাধীকে এক শ্রেণির লোক ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। আমরা দেখলাম, শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন সম্পত্তিতে সম-অধিকার নিয়ে একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ইসলামপন্থি দল। তাকে বদলি করার জন্য চাপ দিল ইসলামপন্থি দল, আর তাদের চাপের মুখে মাথা নত করল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া কিছু দিন আগে লঞ্চে দুই নারীকে জনসম্মুখে পেটালেন যিনি, তাকে সম্প্রতি দেখা গেল মুন্সীগঞ্জে পুলিশ সুপারের মতবিনিময় সভায়। তাহলে অপরাধীদের কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে? সরকারের নীরব ভূমিকা নারীবিদ্বেষী একটি শক্তির উত্থানকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে। জুলাই যোদ্ধা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের প্রক্টর হানিট্র্যাপ বলে কটূক্তি করেছিলেন। তার বিচার না করে উল্টো বহিষ্কার করা হয়েছিল সেই শিক্ষার্থীদেরই। এ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নারীকর্মীদের যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির প্রতিবাদ করায় কোমরে লাথি মারা হয়েছিল। শাহবাগে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারী নারী প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর জল-কামান দিয়ে হামলা করা হয়েছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীরাই সামনের সারিতে ছিলেন। এখন সেই নারীদের অনেকের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে নারীরা। সংগঠিত হয়ে নিজেদের দাবি নিয়ে প্রতিদিন হাজির হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা। এসব মানুষের চোখেই রয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। বাংলাদেশকে পরিবর্তনের জায়গায় নিতে হলে শুধু নারীদেরই আরও সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে, তা নয়, সরকারেরও এখানে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর তাই নারীদের খোঁজা বন্ধ করুন। বরং যারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে চোখের সামনে এসে হাজির হচ্ছে, তাদের দাবির পক্ষে দাঁড়ান। া

অনুলিখন : রণজিৎ সরকার