নারী-পুরুষের নামাজে কি পার্থক্য আছে?
নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমান আনার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নামাজ। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, ইশারায়—যে অবস্থায় সম্ভব নামাজ ছাড়া যাবে না। একজন মুমিন ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, দেশে-বিদেশে, সাগরে-মহাকাশে যেখানেই অবস্থান করে, তাকে নামাজ পড়তেই হবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘...নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩)
প্রশ্ন হলো—এই ফরজ ইবাদত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নিয়ম কি একই, নাকি আলাদা? এর উত্তর হলো—আলাদা। কারণ-নারীর শারীরিক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় পুরুষ থেকে ভিন্ন। যেমন—ইহরাম অবস্থায় পুরুষের জন্য মাথা ঢাকা নিষেধ। কিন্তু মহিলাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় মাথা ঢেকে রাখা ফরজ। ইহরাম খোলার সময় পুরুষ মাথা মুণ্ডায়; কিন্তু মহিলাদের মাথা মুণ্ডানো নিষেধ। পুরুষের ওপর জুমা পড়া ফরজ, নারীদের ওপর নয়। ইমাম ও খতিব শুধু পুরুষই হতে পারে, কোনো নারী হতে পারে না। আজান শুধু পুরুষই দিবে, কোনো নারীকে মুয়াজ্জিন বানানো জায়েজ নয়। পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আর পরপুরুষের সামনে নারীদের প্রায় পুরো শারীরই ঢেকে রাখা ফরজ ইত্যাদি। ঠিক তেমনিভাবে নামাজের নিয়মের ক্ষেত্রেও ইসলামি শরিয়ত নারী-পুরুষের মধ্যে বেশ কিছু বিধানগত ভিন্নতা দিয়েছে। যেমন তাকবিরে তাহরিমার জন্য হাত উঠানো, হাত বাঁধা, রুকু, সেজদা, প্রথম ও শেষ বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষের সঙ্গে নারীর পার্থক্য রয়েছে।
মূলত সতরের পরিমাণ যেহেতু নারীদের বেশি তাই যেভাবে নামাজ পড়লে তাদের নিরাপত্তা বেশি রক্ষা হয় সেদিকটি বিবেচনায় নিয়েছে শরিয়ত। এটি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে চলমান পার্থক্য|। এই বিষয়ে চার মাজহাবের ইমামগণ একমত। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িনদের ফতোয়াও একই। নিচে এ সংক্রান্ত কিছু দলিল উপস্থাপন করা হলো।
১. তাবেয়ি ইয়াজিদ বিন আবি হাবিব (রহ) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদের (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন, ‘যখন সেজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে দেবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। (সুনানে বায়হাকি: ৩০১৬, কিতাবুল মারাসিল লি ইমাম আবু দাউদ-৫৫, হাদিস: ৮০)
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওনুল বারিতে লিখেছেন-‘উল্লেখিত হাদিসটি সব ইমামদের উসুল অনুযায়ী দলীল হিসেবে পেশ করায় যোগ্য।’ (আওনুল বারি: ১/৫২০)
মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আমির ইয়ামানি “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলুগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) এই হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সেজদার পার্থক্য করেছেন।
আরও পড়ুন:
কোন সময় দোয়া করলে বেশি কবুল হয়?
২. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছন, ‘মহিলা যখন নামাজের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তাআলা তাকে দেখে বলেন, ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে বায়হাকি: ২/২২৩, হাদিস: ৩৩২৪)
৩. ওয়াইল বিন হুজর (রা.) বলেন, আমি নবীজি (স.)-এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামাজ শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল মুজামুল কাবি: ২৮)
৪. হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘মহিলা যখন সেজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ৩/১৩৮, হাদিস: ৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে শাইবা: ২/৩০৮, হাদিস: ২৭৯৩, সুনানে কুবরা বায়হাকি: ২/২২২)
৫. ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো- মহিলারা কিভাবে নামাজ আদায় করবে? তিনি বললেন, ‘খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামাজ আদায় করবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১/৩০২, হাদিস: ২৭৯৪)
৬. বিশিষ্ট তাবেয়ি আতা বিন আবি রাবাহকে জিজ্ঞেস করা হলো- ‘নামাজে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে?’ তিনি বললেন-‘বুক বরাবর’। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১/২৭০, হাদিস: ২৪৮৬)
আরও পড়ুন:
হজ নিবন্ধনের সময় বাড়ল ২১ দিন
৭. হানাফি মাজহাবে নারীদের নামাজে বসার পছন্দনীয় পদ্ধতি হলো—উভয় পা এক পাশে মিলিয়ে রাখবে, পুরুষের মতো এক পা দাঁড় করিয়ে রাখবে না। (কিতাবুল আসার: ১/৬০৯, আরো দ্রষ্টব্য- হেদায়া: ১/১০০-১১০-১১১- ফতোয়ায়ে শামি: ১/৫০৪- ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/৭৩)
৮. ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আল্লাহ পাক নারীদেরকে পুরোপুরি পর্দায় থাকার শিক্ষা দিয়েছেন এবং রাসুল (স.)-ও অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হলো- সেজদা অবস্থায় নারীরা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সেজদা এমনভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাজত হয়। (যাখিরা, ইমাম কারাফি: ২/১৯৩)
৯. তাকবিরে নারীদের হাত ওঠানো সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহ) বলেন, হাত তুলনামূলক কম ওঠাবে। (আল মুগনি: ২/১৩৯)
এ পর্যন্ত হাদিস, আসারে সাহাবা, আসারে তাবেয়িন ও ইমামদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতির অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন।
কিন্তু ইদানীং কিছু লোক নারী-পুরুষের নামাজ একই বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। হতে পারে তাদের নিয়ত সহিহ। কিন্তু তাদের দাবিটি সুন্নাহ সমর্থিত নয়। তারা যে হাদিসের উপর ভিত্তি করে নারী-পুরুষের নামাজ অভিন্ন বলে প্রচার করছেন, সেই হাদিসটি হলো-
আরও পড়ুন:
চাঁদ দেখা কমিটির সভা কাল
আবু সুলাইমান মালিক ইবনু হুওয়ায়রিস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়জন নবী (স.)-এর নিকটে আসলাম। তখন আমরা ছিলাম প্রায় সমবয়সী যুবক। বিশ দিন তার কাছে আমরা থাকলাম। তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের নিকট প্রত্যাবর্তন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। যাদের আমরা বাড়িতে রেখে এসেছি তাদের ব্যাপারে তিনি আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তা তাকে জানালাম। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও দয়ার্দ্র। তাই তিনি বললেন- তোমরা তোমাদের পরিজনের কাছে ফিরে যাও। তাদের (কোরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ কর এবং যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনিভাবে সালাত আদায় কর। সালাতের ওয়াক্ত হলে, তোমাদের একজন আজান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামত করবে।’ (বুখারি: ৬০০৮)
এ হাদিসে খেয়াল করুন- এখানে একটি বাক্য হলো-তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছ ঠিক তেমনিভাবে নামাজ পড়ো। এই বাক্যকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে নারী-পুরুষের নামাজ একই বলে প্রচার করছে তারা। অথচ এখানে লক্ষ্য করার আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন—১) যাদেরকে নবীজি কথাগুলো বলছিলেন তারা সবাই পুরুষ সাহাবি ছিলেন। তাদের মধ্যে কোনো নারী ছিলেন না। ২) সেই যুবকদেরকে নবীজি নির্দেশনা দিলেন নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে কোরআন শিক্ষা দিতে, সৎকাজের আদেশ করতে, নামাজের ওয়াক্ত হলে আজান দিতে এবং বড়জনকে ইমামতি করতে। খেয়াল করলে দেখবেন, হাদিসটির শেষদিকে নবীজি (স.) আজান ও ইমামতিরও নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশটি স্পষ্ট করে, এখানে নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করার দাবি সঠিক নয়। কেননা নারী আজান দিতে পারেন না, ইমামও হতে পারেন না।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সত্য বোঝার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুন। সত্য-মিথ্যা নিয়ে সন্দেহ থাকলে চুপ থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।