নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হলো কি?

এহ্সান মাহমুদ
০৬ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হলো কি?

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে কিনা- এটা নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এবারের সন্দেহ তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখছে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান। পাশাপাশি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলছে এমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সখ্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আরও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করছে।

মাত্র এক মাসেরও কম সময় আগে ১৩ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে যে যৌথ ঘোষণা পাওয়া গিয়েছিল, তাতে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কেটেছে বলে মনে হয়েছিল। সেই সময়ে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে।

কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতি এখনও পরিষ্কার নয়। নির্বাচনের জন্য যেটি সবচেয়ে জরুরি, একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা ও সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ- এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি। পাশাপাশি নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি।

এরই মাঝে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। সরকারের দিক থেকে এই বৈঠককে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হয়েছে। আবার নির্বাচন কমিশনও কোনো বক্তব্য দেয়নি। নির্বাচনের সময় নির্ধারণ হয়েছে, এমন আলোচনার পর দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একান্ত বৈঠকের পর স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশিত ছিল যে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সিইসিকে স্পষ্ট বার্তা দেবেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির সাক্ষাতে কী আলাপ হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়নি।

এই ঘটনায় একটি বিষয় পরিষ্কার যে, লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে দেখা যাচ্ছে না। উল্টো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনের দাবি সামনে আসায় জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে।

যদিও ইসি বলছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল- এই দুই সময়ই নির্বাচন হতে পারে ধরে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোটার তালিকার হালনাগাদে প্রায় ৫৯ লাখ নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি ৪৩ লাখের বেশি নতুন ভোটার যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর রাজনৈতিক পক্ষসমূহ ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের কথা বলছে। কিন্তু সেটি নিয়ে এখনও দ্বন্দ্ব কাটেনি। এ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া নিয়েও সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষ। এ বিষয়ে চলতি জুলাইয়ের মধ্যে সুরাহা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া আছে। যদিও ঘোষণা এবং বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আলোচনার শুরুতেই আন্তর্জাতিক মহলের কথা শোনা যেত। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আলোচনা এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও চীন বাংলাদেশে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে আমরা যদি পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো- দেশের ব্যবসায়ীদের একটি অংশও নির্বাচন ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে অবাধ নির্বাচনের প্রয়োজন।

তবে নির্বাচন আয়োজনের সবচেয়ে অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদের কারণে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বহু ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা আমরা জানতে পেরেছি। যে জনগণ এত মূল্য দিয়ে পরিবর্তন এনেছে, সেই জনগণ এ দেশে আরেকটা ফ্যাসিবাদ তৈরি হতে দেবে না। ... এ অবস্থায় দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন কল্পনাও করা যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার করা প্রয়োজন।’ (আমাদের সময়, ৪ জুলাই ২০২৫)

প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, সংস্কারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সরকারের মূল লক্ষ্য। কিন্তু প্রশাসনসহ সব প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ায় ভোট নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। ড. ইউনূস বলেন, এ দায় তিনি নিতে চান না। সরকারপ্রধানের এ আশংকা হয়তো যুক্তিসঙ্গত। তবে তা বাস্তবসম্মত নয়।

আবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবিও দিন দিন বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। দলটি বিচার-সংস্কার-নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ চাইলেও সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের ভোট, ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ আমলের সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করার দাবি জুড়ে দিয়েছে। এতে করে আগামী নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা সরকারের জন্য কঠিন। কিংবা এই কঠিন অবস্থা তৈরি করাটাই এনসিপির রাজনীতি কিনা- এমন আলোচনাও আছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রথম যে শর্ত নির্বাচনী রোডম্যাপ, তা ঘোষণার কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যমান উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং গুঞ্জন কমেছে। কিন্তু নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা এখনও দৃশ্যমান নয়। অভ্যুত্থানের ১১ মাস পরও সরকার দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারেনি। সংস্কার ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারে গতি আসেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক। আবার অর্থনৈতিক সমস্যা প্রকট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচিত সরকার না এলে বিনিয়োগসহ নানা সংকট দিন দিন বাড়বে।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ অন্যান্য দল যারা নির্বাচন চাইছে, সরকারের সঙ্গে এসব দলের আগের মতো হৃদ্যতা থাকবে না। আবার সরকারও বিএনপির মতো বড় দলকে এড়িয়ে কিছু করার চেষ্টা না করলেও সরকারের সমর্থনে অন্যদের শক্তিশালী করার চেষ্টা আছে বলে সাম্প্রতিক ঘটনায় মনে হতে পারে। বিশেষ করে ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে সমাবেশ করার ভিন্ন অর্থ খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। সরকার এ ক্ষেত্রে সফল হলে বিএনপিসহ যারা নির্বাচনের দাবি জোরালো করতে চাইছে তাদের প্রতিপক্ষ বানানো যাবে। এতে করে নির্বাচন ঘিরে সন্দেহ, অনিশ্চয়তা কমিয়ে আনার পরিবর্তে বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।

এহ্সান মাহমুদ : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময়; কথাসাহিত্যিক