পেশা যখন অ্যানিমেশন

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৩ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পেশা যখন অ্যানিমেশন

আইটির বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে অন্যতম একটি জনপ্রিয় সেক্টর অ্যানিমেশন। এর জন্য প্রয়োজন নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশাল কোনো ডিগ্রি অথবা একঝাঁক সার্টিফিকেটের। প্রয়োজন সৃজনশীলতা-বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়, সঙ্গে ধৈর্য-সাধনা-চেষ্টা এবং চিন্তাশক্তি। বর্তমান সময়ে উচ্চ আয় আর সম্মান, সেই সঙ্গে সৃজনশীলতার সমন্বয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে অ্যানিমেটরের সংখ্যা। অ্যানিমেশন বিষয়টি যেমন সহজ, তেমনি আনন্দদায়কও বটে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস

দারুণ জাদুর জগৎ তৈরি করতে এখন মন্ত্র হলো অ্যানিমেশন মাল্টিমিডিয়া। টারজান, আলাদিন, টম অ্যান্ড জেরি, পাপাই, মিনা কার্টুন- সবই অ্যানিমেশনের ফসল। অ্যানিমেশনে মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের দাতা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের মোটিভটি সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরছে। বিশ্ববিখ্যাত হলিউড সিনেমা জুরাসিক পার্ক, টার্মিনেটর, এভেঞ্জার সিরিজ অ্যানিমেশনের কারণেই হয়েছে রোমাঞ্চকর। গেমসের বিভিন্ন চরিত্র আজ দেশে দেশে এত জনপ্রিয় শুধু অ্যানিমেশনের কারণেই। বিজ্ঞাপন, কার্টুন, লোগো কিংবা টয় স্টোরি থেকে শুরু করে হালের অস্কারজয়ী শ্রেষ্ঠ ছবিগুলো অ্যানিমেশনকে এনে দিয়েছে বাড়তি জনপ্রিয়তা। এটা যে পেশার বাজারে নতুন আমদানি হয়েছে তা নয়। বহু বছর ধরেই এটা ছিল। কিন্তু এই সময়ের মতো এত জনপ্রিয়তা হয়তো ছিল না। তাই চাহিদা আর ব্যবহার তুলনায় কম ছিল। কিন্তু নতুন নতুন কার্টুন চরিত্র তৈরি, বিজ্ঞাপন আর চলচ্চিত্রে পটপরিবর্তনের তাগিদ এই পেশাকে এখন জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।

অ্যানিমেটর কে : একজন অ্যানিমেটর ডিজাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভিডিও, সিনেমা, গেমসহ বিভিন্ন ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশনের জন্য অ্যানিমেশন ও গ্রাফিকস তৈরি করেন।

সফল অ্যানিমেটর হওয়ার জন্য সবার প্রথম যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ‘আগ্রহ’। বাকিটা সফটওয়্যারের টুলের ওপর দক্ষতা। অ্যানিমেশন শেখার জন্য বিশেষ কোনো গুণ থাকার দরকার পড়ে না। তাই যে কেউ যে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার মানুষই অ্যানিমেশন শেখার জন্য লং বা শর্ট কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। তবে আড়াই-তিন বছরের কোর্সগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ছোট্ট ‘টেস্ট’ নেওয়া হয়। দিন দিন অ্যানিমেশনের চাহিদা বাড়ছে। বেশির ভাগ কাজই হয় বিভিন্ন স্টুডিওতে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে দারুণ গ্ল্যামারাস জগতে প্রবেশ করার একটা পথ এই পেশা। তা ছাড়াও আছে অন্য অনেক ক্ষেত্রেই এই শিক্ষা কাজে লাগানোর সুযোগ। তাই আগ্রহীরা মন লাগিয়ে শিখলে উন্নতি অবধারিত।

যাদের জন্য এই পেশা : যাদের মধ্যে কার্টুন চরিত্র তৈরি, চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট বদলÑ এজাতীয় কাজ করার আগ্রহ আছে, নতুন কিছু সৃষ্টি করার বাসনা আছে, তারাই আসতে পারেন। তবে এই দুই প্রকার কাজ ছাড়াও একাধিক ক্ষেত্র আছে এই শিক্ষাকে কাজে লাগানোর মতো।

কাজের সুযোগ : পেশা হিসেবে অ্যানিমেটরের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। দেশেও এর চাহিদা কোনো অংশে কম নয়। যদিও অনেকটা দেরিতেই দেশে এ পেশার প্রসার ঘটেছে, তবু দেশেই প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনসহ আন্তর্জাতিক মানের অ্যানিমেটিভ ছবি। আর সে জন্য গড়ে উঠেছে নানা অ্যানিমেশন প্রতিষ্ঠানও।

যেসব প্রতিষ্ঠানে অ্যানিমেটরের কাজের সুযোগ রয়েছে : ভিডিও প্রডাকশন ফার্ম/কোম্পানি। গেম ডেভেলপমেন্ট ফার্ম/কোম্পানি। সফটওয়্যার ফার্ম/কোম্পানি। বিজ্ঞাপনী সংস্থা

দয়িত্ব : ইন্ডাস্ট্রিভেদে অ্যানিমেটরের দায়িত্ব আলাদা হয়। যেমন, গেম ডেভেলপমেন্টে অ্যানিমেটরকে এমন অ্যানিমেশন তৈরি করতে হবে যাতে প্লেয়ারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অ্যানিমেশনে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আসে। আবার বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজটা অনেকটা ভিন্নভাবে।

তবে একজন অ্যানিমেটরের মূল দায়িত্বগুলো হলো :

অ্যানিমেশন ও গ্রাফিকস তৈরির জন্য প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি করা; পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো কাহিনির দৃশ্য, চরিত্রসহ প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুর বাস্তবসম্মত মডেল বানানো; কাহিনির সঙ্গে মিল রেখে দৃশ্য ও চরিত্রগুলোকে অ্যানিমেটেড করা; অ্যানিমেশনের মান উন্নয়ন করা।

শিক্ষাগত যোগ্যতা : সাধারণত মাল্টিমিডিয়া ডিজাইনে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। তবে পোর্টফোলিও বা কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যোগ্যতা শিথিল করা হতে পারে।

প্রশিক্ষণ : অ্যানিমেশনের প্রধান দুটি সফটওয়্যার হলো মূলত থ্রিডি ম্যাক্স ও মায়া। এই সফটওয়্যারগুলো এবং এ সংক্রান্ত মাল্টিমিডিয়া লার্নিং সিডিসহ বই কিনে ঘরে বসে কারও সহায়তায় বা নিজে নিজেই অ্যানিমেশনের কাজ শেখা সম্ভব। তা ছাড়া ইন্টারনেটে আইটি সংক্রান্ত বিভিন্ন সাইটে রয়েছে অসংখ্য ফ্রি টিউটোরিয়াল, বই ও সহায়ক গাইডলাইন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও অ্যানিমেশন শেখা যায়। এ ছাড়া অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইনে বেসিক কোর্সের ক্লাস নিয়ে থাকেন।

সাধারণত উচ্চ মাধ্যমিকের পরই আগ্রহীরা অ্যানিমেশন শেখার জন্য কোর্সে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। অনেকে মাধ্যমিকের পরও ভর্তি হয়। আবার স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেও কেউ কেউ এই শিক্ষা নিয়ে থাকেন।

যেসব বিষয়ের ওপর দক্ষতা আর্জন করা প্রয়োজন : গ্রাফিকস ডিজাইনিং (Adobe Photoshop, Adobe illustrator)। অডিও ভিডিও এডিটিং (Adobe Premiere, Adobe After Effects, Adobe Audition)। মুভি ট্রেলার মেকিং। টুডি অ্যানিমেশন (Adobe Character Animator, Adobe Animate, Autodesk Sketchbook)। থ্রিডি অ্যানিমেশন (Autodesk 3DS Max, Cinema 4D, Blender)। ম্যাক্স (ইন্টিরিয়র ডিজাইন)। Autodesk Maya (ক্যারেকটার ডিজাইনিং)। ভিএফএক্স।

পাশাপাশি দরকার : স্টোরিবোর্ডিং বা কাহিনি অনুযায়ী সঠিকভাবে দৃশ্য সাজানোর দক্ষতা

সিনেমাটোগ্রাফি ও লাইটিং সম্পর্কিত ধারণা

মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর অভিব্যক্তি ও নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা

এর বাইরে থাকতে হবে : সৃজনশীলতা। যোগাযোগের দক্ষতা। দলগত কাজের দক্ষতা

কোথায় শিখবেন অ্যানিমেশন : সরাসরি থ্রিডি অ্যানিমেশন নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আমাদের দেশে সীমিত। তবে মাল্টিমিডিয়া ডিজাইনের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ের ওপর কাজ শেখার সুযোগ পান। এমন কিছু ডিগ্রি ও কোর্স হলো :

বিএ (অনার্স)- গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি

বিএসসিÑ মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি

ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ

বাংলাদেশ কোরিয়া ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (BKIICT) পরিচালিত ‘3D Modeling & Animation’ ও ‘2D Modeling, Animation & Effects’ শর্ট কোর্স

কোর্সের জন্য খরচ কত : মোটামুটি ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। অর্থাৎ কী ধরনের কোর্স করা হবে, তার সময়সীমা কত ইত্যাদির ওপর খরচ নির্ভর করছে। তবে পেমেন্টের ক্ষেত্রে ইনস্টলমেন্টের ব্যবস্থা থাকে বেশির ভাগ সংস্থাতেই।

কত দিনের কোর্স : বিভিন্ন কোর্সের গুরুত্বের ওপর তার সময়সীমা নির্ভর করে। তবে তিন মাস থেকে তিন বছরের কোর্সও করানো হয়। ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট কোর্সের সময়সীমা আলাদা আলাদা হয়।

আয়-রোজগার : পেশা হিসেবে অ্যানিমেটরের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। দেশেও এর চাহিদা কোনো অংশে কম নয়। যদিও অনেকটা দেরিতেই দেশে এ পেশার প্রসার ঘটেছে, তবু দেশেই প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনসহ আন্তর্জাতিক মানের অ্যানিমেটিভ ছবি। আর সে জন্য গড়ে উঠেছে নানা অ্যানিমেশন প্রতিষ্ঠানও।

দক্ষ অ্যানিমেটর হলে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব। আয় নির্ভর করছে কোন সংস্থায় কাজ পাচ্ছে, কী ধরনের কাজ করছে তার ওপর। কেউ যেমন প্রথম কাজে ঢুকেই ১০ হাজার পাচ্ছে, আবার কেউ ২৫ হাজারও পাচ্ছে। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্স কাজ করেও আয় করা সম্ভব। অভিজ্ঞতার সঙ্গে আয়ও বাড়বে। এ পেশায় দক্ষতা থাকলে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করা সম্ভব।

ক্যারিয়ার গ্রাফ : বর্তমানে বিজ্ঞাপন, সিনেমা, টেলিভিশন ও গেম ডেভেলপমেন্টের প্রসার হওয়ার কারণে থ্রিডি অ্যানিমেটরদের চাহিদাও অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে এই ক্যারিয়ারে গতানুগতিক পদোন্নতির ব্যবস্থা খুব কম জায়গায় রয়েছে। বরং প্রজেক্টের ভিত্তিতে দায়িত্ব ও পদবি নির্ধারিত হয়ে থাকে, যেমনÑ টিম লিডার, প্রজেক্ট ম্যানেজার ইত্যাদি। শীর্ষ পর্যায়ে অ্যানিমেশন ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করার সুযোগ থাকে।