ঈদেও যাদের স্বপ্ন বাড়ি যায় না

জাবি প্রতিনিধি
০৪ জুন ২০২৫, ১২:০৫
শেয়ার :
ঈদেও যাদের স্বপ্ন বাড়ি যায় না

ঈদ মানেই আনন্দ। এই আনন্দ প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে বাড়িতে ফিরে সবাই। টিকেট সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাত্রাপথে নানা ভোগান্তি সত্ত্বেও দূর-দুরান্তে থাকা মানুষেরা ফিরতে চায় আপন নীড়ে। তবে সবার ভাগ্যে এই আনন্দ জোটে না। সবাই যখন ঈদের আবহে মত্ত, তখনও একদল মানুষ জীবিকার টানে এবং দায়িত্বের কারণে ইট-পাথরের অচেনা ঠিকানায় কর্মস্থলেই পালন করবেন ঈদ।

ঈদের ছুটিতে এখন অনেকটাই নীরব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই রয়েছেন ছুটিতে। শুধু ছুটি মেলেনি সেই মানুষগুলোর, যারা এই বিশাল ৭০০ একরের আবাসিক ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। ঈদের এই আনন্দঘন মুহূর্তে যখন সবার দায়িত্ব কমে যায়, তখন প্রায় জনশূন্য এই ক্যাম্পাসে তাদের দায়িত্ব যেন বেড়ে যায় কয়েকগুণ । সকলের নিকট ভাই সম্বোধিত সেই মানুষগুলো দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আগলে রাখেন এই সবুজ প্রান্তরকে। হাসিমুখে বিদায় জানাচ্ছেন ছুটিতে যাওয়া চেনা মুখগুলোকে, আর বুকের গভীরে চাপা রাখছেন পরিবার ছেড়ে দূরে থাকার বেদনা। এভাবেই কর্মস্থলে ঈদ কাটবে তাদের।

বিশ্ববিদ্যালয় ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) আবু সাইদ জিন্নাহ সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী ও ১৮৭ জনের আনসার টিম আউটসোর্সিংয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের ঈদে ছুটি দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তবে এ সময় সর্বোচ্চ ৫জন নৈমিত্তিক ছুটি পান। বাকিদের কাঁধে ন্যস্ত এই বিশাল ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার গুরুভার।

যারা ক্যাম্পাসের পাহারায় থাকবেন, তাদের হয়তো ঈদের সকালে মায়ের হাতের রান্না কিংবা বাবার আলিঙ্গন জুটবে না। তাদের ঈদ কাটবে সহকর্মীদের সঙ্গে, এ এক ব্যতিক্রমধর্মী ঈদ। পরিবারের কাছে যেতে না পারার একটা চাপা কষ্ট হয়তো তাদের বুকেও ঢেউ তোলে। তবে তাদের কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারীরা নিশ্চিন্তে আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করেন, এটিই যেন তাদের সান্ত্বনা।

দীর্ঘ ৩৩ বছরের কর্মজীবনে গ্রামের বাড়ি বগুড়াতে একবার ঈদ করেছেন সামসুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এতবড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের নিরাপত্তাও তো দিতে হবে। দায়িত্বের কথা ভেবে বাড়ি যাওয়া হয়না। এই ত্যাগ দায়িত্বের জন্য, পরিবারের জন্যই। যখন দেখি শিক্ষার্থী ও অন্যান্য দায়িত্বে থাকা সহকর্মীরা হাসিমুখে পরিবারের কাছে যাচ্ছে, তখন এক অন্যরকম আনন্দ হয়। জাহাঙ্গীরনগর তো আমার দ্বিতীয় পরিবার।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা তুষার ভাইয়ের কন্ঠেও একই সুর। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ আর ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসিক কক্ষ নিরাপদে রাখাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। ঈদের ছুটিতে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করার মাঝেও এক ধরনের শান্তি খুঁজে পাই।‘

তবে, ছুটির দিনে কর্তব্যরত এই মানুষগুলোর মনে একটি চাপা দীর্ঘশ্বাসও রয়েছে। ঈদের ছুটিতে দায়িত্ব পালনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক দৈনিক ২৪০ টাকা দেওয়া হয়। এই ভাতার পরিমাণ নিয়ে তাদের কিছু আক্ষেপ শোনা যায়। একজন দিনমজুর রোজ ৬০০-৮০০ টাকা রোজগার করে, অথচ ঈদের বিশেষ দিনে দায়িত্ব পালনের জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের দেওয়া হয় ২৪০ টাকা। এই পারিশ্রমিককে তারা কাজের তুলনায় খুবই নগণ্য মনে করেন। এদিকে গত ২২ মে অর্থমন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে সরকারি কাজে একজন দিনমজুরের দৈনিক মজুরি ৭৫০-৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তাকর্মীদের এই প্রাপ্তি হতাশাজনক।

এই ঈদে যাদের স্বপ্ন বাড়ি যায় না, তাদের নীরব ত্যাগ আর কর্তব্যনিষ্ঠা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ঈদের আনন্দ শুধু আপনজনের সান্নিধ্যে নয়, দায়িত্ব পালনের মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, ‘তারা পরিবার-পরিজন ছেড়ে ছুটির দিনেও নিরলসভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে কল্যানমুখী ও আধুনিক করার জন্য আমরা কাজ করছি। আগামীতে তাদের জন্য আরও সুবিধাদি দেওয়ার চেষ্টা করব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈদের ছুটিতে এটি আরও স্পর্শকাতর হয়ে যায়। আমি নিজেও ক্যাম্পাসেই রয়েছি। নিরাপত্তাকর্মীদের এই ত্যাগ আমাদের ঋণী করেছে।’