নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে রোহিঙ্গানীতিতে জাতীয় ঐকমত্যের লক্ষ্যে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের আয়োজনে ‘বাংলাদেশের রোহিঙ্গা নীতিতে জাতীয় ঐকমত্যের পথে’ শীর্ষক একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) অডিটোরিয়ামে আজ শনিবার এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপের সহযোগী আয়োজক ছিল এনএসইউ’র দ্য সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) ও সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজ (সিএমএস)।
সংলাপে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করেন বক্তারা। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যকরের ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতি তৈরি করা। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যা পরবর্তীতে দেশের ওপর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুতর চাপ সৃষ্টি হয়।
উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ। শুরুতে এসআইপিজি-এর পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম. হক তার সূচনা বক্তব্য দেন এবং এ আলোচনার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এসআইপিজি-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এর ধারাবাহিকতায় এনএসইউ-এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বুলবুল আশরাফ সিদ্দিকী তার আলোচনায় পরিস্থিতির গভীরতা তুলে ধরেন। বিশেষ অতিথিদের মধ্যে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, যারা এ শরণার্থী সংকট ব্যবস্থাপনার তাদের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
এসআইপিজি-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান শরণার্থী শিবির এবং আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এতে করে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এছাড়া তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ আগের মতো সমর্থন ধরে রাখতে হিমশিম খেতে পারে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবিক প্রচেষ্টা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য উদার সমর্থনের আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশকে ভারত, চীন, জাপান, নেপাল এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়ে এই সমস্যাগুলোর সমাধানে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’
অধ্যাপক শেখ তৌফিক তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতির দীর্ঘ ইতিহাস উল্লেখ করে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্ব দেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ব্র্যাক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃত্বে ভাসান চরে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চললেও গত সাত বছরে কোনো রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।
ড. বুলবুল আশরাফ সিদ্দিকী রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, এ পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলো মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার একটি সংক্ষেপিত নথিতে সীমাবদ্ধ। তিনি একটি সমন্বিত কৌশলের অভাবের কথা উল্লেখ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা এবং প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দেন।
মিস গুইন লুইস শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বাংলাদেশের উদারতা স্বীকৃতি দিয়ে বলেন যে, এ সমস্যায় জরুরি রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যক্রম অপর্যাপ্ত। তাই জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক সমর্থন বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া রাখাইনে মানুষের জন্য মানবিকতার খাতিরে করিডোর খোলার প্রেক্ষিতে যেসব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরী হবে তা মোকাবিলায় এসব দেশগুলোর বিকল্প সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
আইওএম-এর ল্যান্স বুনো রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষর না করা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তিনি একইসাথে ২০০০ সাল থেকে আইওএম এর রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন দেওয়ার এবং এ মানবিক সংকটের টেকসই সমাধানে তাদের কাজের কথা উল্লেখ করেন। ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক অর্থায়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিশুদের, ক্যাম্পের বাইরে একটি স্বাভাবিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা তিনি উল্লেখ করেন।
আরও পড়ুন:
উখিয়ায় রোহিঙ্গা নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
মিস সুমবুল রিজভি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ (এফডিএমএন) শব্দটির গুরুত্ব দিয়ে বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এই সূক্ষ্ম বোঝাপড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বৃহত্তর সমর্থন আনতে সহায়ক হতে পারে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ সীমান্তবর্তী হুমকি, যেমন মাদক চক্র এবং মানব পাচার, সমাধানে একটি সমন্বিত কৌশলের জরুরি প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার গুরুত্বও তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন যে, বাড়তে থাকা আঞ্চলিক সহিংসতা এবং প্রত্যাবাসনের ক্ষীণ সম্ভাবনা সংকটকে আরও গভীর করতে পারে, তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য একটি কৌশলগত রোডম্যাপ প্রয়োজন।
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে মি. রহমান নীতি বাস্তবায়নে অ্যাড-হকিজমের কারণে সৃষ্ট সিস্টেমিক চ্যালেঞ্জগুলি তুলে ধরেন। তিনি ঢাকার নীতিনির্ধারকদের এবং টেকনাফের বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বের কারণে যে লজিস্টিক এবং কার্যকরী অদক্ষতা তৈরি হয়েছে তা নির্দেশ করেন। ‘আমার অফিসের জন্য কোনো নির্দিষ্ট নীতি বা কর্মচারী পরিচালনার জন্য স্পষ্ট প্রোটোকল না থাকায়, অগ্রগতি ধীর গতিতে চলছে’- বলে তিনি বলেন।
এছাড়া তিনি রোহিঙ্গাদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সতর্ক করে বলেন যে, এসব উদ্যোগ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং পুনর্মিলন প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে পারে। তিনি আরও বলেন,‘১২ ডলার মাথাপিছু দিয়ে সবাইকে খাবার কীভাবে দেব?’ ৭৩% রোহিঙ্গা বাইরের বাজার থেকে খাবার কিনে, তারা কোথা থেকে টাকা পায়?
জেনারেল নাজিমুদ্দিন ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবের কথা তুলে ধরেন, তিনি বলেন,‘আমাদের কোনো মিত্র আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি—ভারত, রাশিয়া বা চীনও না।’ তিনি শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান, বলেছিলেন, ‘শুধু কথায় এই সমস্যা সমাধান হবে না; এটি দৃঢ় পদক্ষেপের প্রয়োজন।’ তিনি দুটি স্পষ্ট বিকল্প উপস্থাপন করেন—রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা অথবা তাদের নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। এছাড়াও, তিনি সতর্ক করেন যে একটি নিষ্ক্রিয় মনোভাব গ্রহণ করা বিপজ্জনক হতে পারে, যা অন্যান্য অঞ্চল থেকে আরও রোহিঙ্গা প্রবাহিত হতে উত্সাহিত করতে পারে।
সংলাপে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন সংস্থা, এনজিও, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দসহ আরও উপস্থিত ছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সমাপনী অধিবেশনে বিকাল চারটায় উপস্থিত থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।